নালিতাবাড়ী

সংগ্রাম,আন্দোলন,ইতিহাস,ঐতিহ্য ও অর্জনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ”

  স্বাধীন বাংলা নিউজ ২২ জুন ২০২৩ , ৮:১৫ পিএম অনলাইন সংস্করণ

সংগ্রাম,আন্দোলন,ইতিহাস,ঐতিহ্য ও অর্জনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ”



“সংগ্রাম,আন্দোলন,ইতিহাস,ঐতিহ্য ও অর্জনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ”।
সরকার গোলাম ফারুক 
সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক(ভারপ্রাপ্ত) নালিতাবাড়ী উপজেলা শাখা
…………………………………………………..
ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭৪ বছরে পদার্পণ করছে। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন বিকালে ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় নতুন একটি রাজনৈতিক দল “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ”। পরবর্তীতে সেই দলের নাম পরিবর্তন করে “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ” করা হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে কয়জন প্রোগ্রেসিভ বা উদারপন্থী নেতা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদেরকে অবহেলিত মনে করতেন। সেকারণে তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন,তখন কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সাথে যুক্ত হন।
সেসময় টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করার কারণে শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক কিন্তু তাদের দুজনের নির্বাচনী ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তখন তারাও এসে এই মুসলিম কর্মীদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মাওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। সভা করার জন্য কোন অডিটোরিয়াম পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহবান জানান।
সেখানেই ২৩শে জুন বিকালে আড়াইশো-তিনশো লোকের উপস্থিতিতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ”। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় “নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নবগঠিত রাজনৈতিক এই দলের নেতৃত্বে—
নতুন দল গঠনের পর মাওলানা ভাসানীকে দায়িত্ব দেয়া হয় একটি নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করার জন্য। তিনি অন্যদের সাথে পরামর্শ করে একটি কমিটি ঘোষণা করেন। সেই নতুন কমিটির সভাপতি হন মাওলানা ভাসানী,সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান,আলী আমজাদ খান,আহমেদ আলী খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আবদুস সালাম খান এবং সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান,যার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে প্রথম সভার আয়োজন করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
এভাবেই প্রথম ৪০ জনের কমিটি গঠিত হয়। সে কমিটিতে আমার পিতা মরহুম আব্দুল হাকিম সরকারের নামটিও ছিল। আমি আমার পিতার ডায়েরি থেকে জেনেছি আমার ছোট চাচা মোক্তার হোসেন ( লন্ডন প্রবাসী, এপর্যন্ত দেশে ফিরেন নি ) ঢাকায় হাতিরপুল ভূতের গলি নিজ বাসায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সেখান থেকে বাবা জাতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী,শামছুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ঘনিষ্ঠ হন।
প্রতিষ্ঠার একদিন পর ২৪শে জুন আরমানিটোলা ময়দানে একটি জনসভা ডাকা হয়েছিল কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগের কর্মীরা সেই সভায় হামলা করেছিলেন। অলি আহাদের বইতে একটি ভাষ্য পাওয়া যায় যে, রোজ গার্ডেনের সভায় কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন এ কে ফজলুল হক। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন (বর্তমানে এই পদটি অ্যাটর্নি জেনারেল )। কিন্তু সরকারি পদে থাকার কারণে তিনি কিছুক্ষণ পরেই সেখান থেকে চলে যান।
দলের নামের সঙ্গে মুসলিম শব্দটি থাকায় কেউ কেউ আপত্তি করেছিলেন নামের পরিবর্তন নিয়ে এবং এ নিয়ে দলে বেশ বিরোধ তৈরি হয়েছিল,যে মুসলিম শব্দটি থাকবে নাকি থাকবে না। তখন হিন্দু এবং মুসলিম আসনে আলাদাভাবে নির্বাচন হত। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় একটা সমঝোতা হয়েছিল যে, এই দলটি একটি অসাম্প্রদায়িক দল হবে। সেসময় যুক্তফ্রন্টের প্রধান তিন নেতা ছিলেন মাওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। যদিও মাওলানা ভাসানী দলকে অসাম্প্রদায়িক করতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চাইছিলেন যে মুসলিম শব্দটি থাকুক। কারণ তার ভয় ছিল,এটা বাদ দিলে পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা কমে যাবে। 
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পায় যুক্তফ্রন্ট,পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টে বাকি চারটি দল ছিল কৃষক শ্রমিক পার্টি,পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল,পাকিস্তান খেলাফত পার্টি আর নেজামে ইসলামী পার্টি । এই নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ একাই পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগে যে কাউন্সিল হয়,সেখানে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ফলে অমুসলিমরাও এই দলে যোগ দেয়ার সুযোগ পান,তবে পূর্ব পাকিস্তান শব্দ দুইটি বাদ পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর থেকে প্রবাসী সরকারের সব কাগজপত্রে অটোমেটিকেলি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ব্যবহার হতে শুরু করে।
১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় এবং তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তবে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মত-পার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে এই রাজনৈতিক দলটিতে ভাঙন দেখা দেয়। 
তখন আওয়ামীলীগ পাকিস্তানের সরকারে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের কয়েকটি সামরিক চুক্তি হয়। সিয়াটো এবং সেন্টো সামরিক জোটে পাকিস্তান সদস্য ছিল। মাওলানা ভাসানী এবং দলের মধ্যে থাকা বামপন্থীরা চাপ দিচ্ছিলেন যাতে আওয়ামী লীগ মার্কিন সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে আসে। সোহরাওয়াদীকে মার্কিন চুক্তির সমর্থক বলে মনে করা হতো। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি করছিলেন মাওলানা ভাসানী, কিন্তু তাতে রাজি হননি প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী।
ওই বিরোধের একটা পর্যায়ে এসে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে দলের যে সম্মেলন হয়, সেখানে মাওলানা ভাসানীর প্রস্তাবটি ভোটাভুটিতে হেরে যায়। এরপর ১৮ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মাওলানা ভাসানী। সেই বছর ২৫শে জুলাই তিনি ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে অনেক নেতা তার নতুন দলে যোগ দেন, যাদের মধ্যে ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইয়ার মোহাম্মদ খানও।
তখন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। সাধারণ সম্পাদক হিসাবে থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামীলীগ আবার পুনর্গঠন হয়। আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার জন্য তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন শেখ মুজিব কিন্তু মানিক মিয়া তাতে রাজি হননি, কারণ তিনি লেখালেখি নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। জাস্টিস মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামের সাবেক একজন মন্ত্রীকেও অনুরোধ করা হয়েছিল, কিন্তু তিনিও সভাপতির দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। তখন ১৯৬৪ সালের কাউন্সিলে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে পুরোপুরি সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক থেকে যান।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষণা করার পর মাওলানা তর্কবাগীশসহ অনেকেই তার বিরোধিতা করেন। ঐ বছর মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। যারা ছয় দফার বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের অনেক নেতাই আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এই নেতৃত্বের হাত ধরেই ( বঙ্গবন্ধু -তাজউদ্দিন ) আজকের এই বাংলাদেশ—-স্বাধীন বাংলাদেশ।
সরকার গোলাম ফারুক 
সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ( ভারপ্রাপ্ত ),নালিতাবাড়ী উপজেলা শাখা।