নালিতাবাড়ী

অধ্যাপক আবদুস সালাম : মাটি ও মানুষের রাজনীতিক

  স্বাধীন বাংলা নিউজ ১৭ মার্চ ২০২৩ , ১১:১৯ পিএম অনলাইন সংস্করণ

অধ্যাপক আবদুস সালাম : মাটি ও মানুষের রাজনীতিক



অধ্যাপক আবদুস সালাম : মাটি ও মানুষের রাজনীতিক।
(রিয়াদ আল ফেরদৌস)
প্রান্তিক জনপদ নালিতাবাড়ী উপজেলার বহু শতাব্দীর সংগ্রামী ঐতিহ্য ও সংগ্রামের স্বাক্ষী বহন করে চলে। স্বাধীনতা উত্তর নালিতাবাড়ীতে জাতীয় রাজনীতির মাঠে আবদুস সালাম একটি অবিচ্ছেদ্য নাম। সীমান্ত লাগোয়া নালিতাবাড়ীর প্রত্যন্ত নয়াবিল গ্রামে বিগত শতাব্দীর তিনের দশকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা নয়াবিল গ্রামে তারপর যথাক্রমে তারাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ আঙিনায় উচ্চশিক্ষ অর্জন করেন। ষাটের দশকে (১৯৫৯)সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র সংসদ থেকে রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল তার তবে কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়। সুনামগঞ্জ কলেজ, জামালপুর ও গৌরিপুর কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে। সালাম সাহেব স্কুল জীবন থেকেই সংস্কৃতিমনা ছিলেন এবং নাট্যমঞ্চে অভিনয় করেছেন। ব্যক্তি জীবনে সদালাপী ও মিষ্টভাষীতা তার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। ১৯৭১ সালের শুরুতে দেশ যখন অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দেশে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে নালিতাবাড়ীতে সালাম সাহেব সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব হয়েছিলেন। রাজনীতি সেবী আবদুস সালাম রাজনীতি চর্চায় আত্মপ্রচার বিমুখ তবে তিনি বিশ্বাস করতেন একজনের কর্মফলই রাজনৈতিক ভাগ্যোন্নয়নের সুযোগ এনে দেয়। সত্তরের দশকে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতার প্রথম দশক ছিলো রক্তাক্ত রাজনৈতিক পালাবদলের খেলা, ভাগ্য তাকে নিরাশ করেনি। দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও চতুর্থ জাতীয় সংসদে শেরপুর ২ আসনে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং বিভিন্ন মেয়াদে মন্ত্রিসভায় স্থান করে নিয়েছেন স্বপ্রতিভায় এবং প্রান্তিক জনপদ নালিতাবাড়ীকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন জাতীয় ক্ষেত্রগুলোতে। শিক্ষা বিস্তার, গণমুখী যোগাযোগ উন্নয়ন, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়নের জন্য রাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে নন্দিত হয়েছেন মানুষের কাছে। আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে স্বপ্ন দেখতেন অধ্যাপক আবদুস সালাম। ক্রিড়া ও সংস্কৃতির নি:স্বার্থ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি সুখ্যাতিপ্রাপ্ত। শিক্ষাগুরু প্রয়াত নগেন্দ্র চন্দ্র পাল স্যারের ছাত্র ছিলেন আবদুস সালাম সাহেব। শিক্ষাগুরু র প্রতি দেবতুল্য ভক্তি তিনি আজীবন প্রদর্শন করেছেন এবং যেদিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশত্যাগ করে ভারতের মেঘালয়ে চলে যান অধ্যাপক আবদুস সালাম দুনালা বন্ধুক সমেত নিরাপত্তা ব্যাবস্থা করে শিক্ষাগুরুকে সীমান্ত পাড় করে দেন। আজীবন আওয়ামী রাজনীতির বিপরিতগামী স্রোতে রাজনীতি করা আবদুস সালাম সাহেব সারা জীবন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর ছিলেন বিনম্র শ্রদ্ধাশীল। ১৯৯৬ সালে সর্বশেষ তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেরপুর ২ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্বাচনী জাতীয় রাজনীতিতে এটাই তার শেষ অংশগ্রহণ ছিলো তার। এর মাঝে তিনি আটের দশকে স্থানীয় সরকার ব্যাবস্থা সংস্কার হলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে যায় জাতীয় রাজনৈতিক মেরুকরণে তিনি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন কে কেন্দ্র করে জোট রাজনীতির মেরুকরণে দেশ বিভক্ত হয়ে পড়ে। ময়মনসিংহ উত্তর অঞ্চলে আওয়ামিলীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের পক্ষে তিনি একাত্ম হয়ে কাজ করেন এবং রাজনৈতিক কৌশলে জয়লাভ করেন। এরপর আবার সময় বয়ে চলে ,দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা , জরুরি অবস্থা, সামরিক শাসক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পেরিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করে। স্থানীয় সরকার ব্যাবস্থা পুনঃ সংস্কার হলে বিলুপ্ত উপজেলা পরিষদ আবার চালু হয় এবং সারা দেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অধ্যাপক আবদুস সালাম সাহেব প্রার্থী হয়েছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বদিউজ্জামান বাদশা। নির্বাচনে অধ্যাপক আবদুস সালাম হেরে গিয়েছিলেন । এটাই তার জীবনের শেষ নির্বাচন। জীবদ্দশায় তিনি নিজেকে জন্ম ঋন স্খলনের কজে ব্যায় করেছিলেন। তিনি প্রায়শই একটি বাক্য জনসভায় আবৃত্তি করতেন – ‘ জননী জন্মভূমিষ্ঠ স্বর্গাজতি গরিয়সী’ । জন্মভূমি নালিতাবাড়ীকে উপজীব্য করে দীর্ঘ তিন বছর বা বেশি সময় তথ্য উপাত্ত নিয়ে একটি গবেষণা গ্রান্থ সংকলন করেন ” নালিতাবাড়ীর মাটি মানুষ এবং আমি” । আদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে যারা নালিতাবাড়ীকে জানতে চাইবে তাদের জন্য একটি আকড় গ্রন্থ এটি। শেষ নির্বাচনের শেষ জনসভায় তিনি একটা শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন শহীদমিনার মাঠ মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চে । জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি জনগণকে সেবা করার সুযোগ দেবার আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি নালিতাবাড়ীর মাটি ও মানুষের মাঝে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করতে চান এবং এই মাটি ও মানুষ যেন তার অন্তিমক্রিয়া সম্পাদন করেন সেই অনুরোধ রাখেন। ২০১১ সালের ১৭ মার্চ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন রাজনীতি অন্তপ্রাণ অধ্যাপক আবদুস সালাম । তার অনুরোধ নালিতাবাড়ীর মাটি ও মানুষ সম্মানের সাথে রেখেছিলো। আজ অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রয়াত হয়েছেন এক যুগ হয়ে গেল। তিনি নালিতাবাড়ীর ভূমিপুত্র স্মরণীয় ও বরণীয় একজন মানুষ। আঞ্চলিক উন্নয়ন শিক্ষা ক্রিড়া ও সংস্কৃতির তিনি পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সময়ের প্রবাহে ধুলোমলিন হয়ে যায় স্মৃতি বিস্মৃতির ইতিহাসের ভাঙা টুকরোগুলো। অধ্যাপক আবদুস সালামের প্রয়ান দিবসে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তার অম্লান স্মৃতি ।