বাংলাদেশ

হাতি ও মানুষের দ্বান্দ্বিকতার বাস্তব চিত্র-রিয়াদ আল ফেরদৌস

  স্বাধীন বাংলা নিউজ ১২ অগাস্ট ২০২৩ , ৪:০৫ পিএম অনলাইন সংস্করণ

হাতি ও মানুষের দ্বান্দ্বিকতার বাস্তব চিত্র-রিয়াদ আল ফেরদৌস



হাতি ও মানুষের দ্বান্দ্বিকতার বাস্তব চিত্র রিয়াদ আল ফেরদৌস 
খাদ্যের যোগান ও কৃষি উৎপাদনের সুরক্ষার স্বার্থে বন্যপ্রাণীর সাথে লড়াই ছিলো জীবনের অপরিহার্য ক্রিয়া। মেটাভার্সের জমানায় কৃষিজীবীদের বন্যা জন্তুর (হাতি) সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবার প্রথা রীতিমতো রূপকথার থেকে কম নয়, যদিও সীমান্তে বন্যপ্রাণীর সাথে লড়াই করে বাঁচা নতুন কোন ঘটনা নয়।
ভারতের মেঘালয় অঙ্গরাজ্যের সীমান্তঘেঁষে গারো পাহাড়ের শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার (শেরপুর জেলা সদর হতে ৩৫.৩ কিঃমিঃ উত্তরে সীমান্তবর্তী অবস্থান)কর্ণঝোড়া, বাবলাকোনা, রাজার পাহাড়, ঝোলগাঁও, কোচপাড়া, রাঙ্গাজান, খাড়ামোরা হারিয়াকোনা ও মেঘাদলসহ ১৩টি গ্রাম; নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাকুগাঁও স্থলবন্দর (শেরপুর জেলা সদর হতে ৩৩.৫ কিঃমিঃ উত্তর পূর্বে সীমান্তবর্তী অবস্থান) এলাকার কাটাবাড়ি, পানিহাটা, তারানী, খলচান্দা, হাতিপাগাড়, দাওধারা, বাতকুচি ও বুরুঙ্গাসহ প্রায় ১২টি গ্রাম এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার (শেরপুর জেলা সদর হতে ৩০.৯ কিঃমিঃ উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী অবস্থান) বড় গজনী, ছোট গজনী, রাংটিয়া, সন্ধ্যাকুড়া, পানবড়, নকশী, তাওয়াকুচা ও গুরুচরন দুধনইসহ প্রায় ১৩ টি গ্রামে বাঙালী, খ্রিষ্টান, গারো, ডালু, কোচ ও হাজংসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মিলে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের বাস। এই অঞ্চলের বনাঞ্চল অপেক্ষাকৃত সমতল। লাগোয়া ভারত সীমান্তের ঘন অরণ্যে অগণিত বন্যহাতির বিচরণ। ময়মনসিংহ বন বিভাগ এবং শেরপুর বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যালয়ের হিসেবে দীর্ঘ ২৭ বছরে (১৯৯৫ থেকে হাল বছর পর্যন্ত) শেরপুর সীমান্তের গারো পাহাড়ে হাতির আক্রমণে ৬০ তদূর্ধ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন শতাধিক (চলমান)। অপরদিকে, হাতি মারা গেছে ৩৩টি বা তদূর্ধ (চলমান)। হাতিগুলোর বেশিরভাগ মারা গেছে গুলিবিদ্ধ হয়ে,ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কিংবা বৈদ্যুতিক ফাঁদে। আর কিছু সংখ্যক মারা গেছে খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে। এ যুদ্ধ চলে আসছে নব্বই দশকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত।
 (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার) সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী শেরপুরের গারো পাহাড়ে আট হাজার ৩৭৬ একরজুড়ে রয়েছে বনভূমি। এ বনভূমি সহ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও জামালপুরের বকশীগঞ্জের বনভূমিতে বিচরণ করে ১২৫টির বেশি হাতি। নালিতাবাড়ী ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা এবং সে উপজেলাগুলোর বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত গারো পাহাড়। এককালে এই বনাঞ্চল হাতি, বুনো শুকর, হরিণ ভাল্লুকের অভয়ারণ্য ছিলো। কিন্তু সীমান্তের এসব পাহাড়ি এলাকায় মানুষ দিন দিন বসতি গড়ে তোলায় ক্রমেই বন্ধ হয়ে যায় হাতির চলাচল ও খাদ্য ও পানির সংস্থানের জায়গা। এতে প্রতি বছরই সীমান্তের ওপার থেকে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসছে হাতির দল। আর তখনই শুরু হচ্ছে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব। হাতি দলবেঁধে চলাকালে করে ও খাদ্যের সংস্থান করে থাকে। হাতির পাল ফসলের মৌসুমে দলবেঁধে সীমান্ত অতিক্রম করে সীমান্ত কৃষকদের আবাদি জায়গা ও ফলবাগানে তশ্রুব চালায়। বর্ষাকালে কাঁঠালের বেশ প্রাচুর্য থাকে এসব পাহাড়ি এলাকায় আর হাতির বেশ পছন্দনীয় খাদ্যের মাঝে কাঁঠাল অন্যতম। ক্ষুদ্র প্রান্তিক সীমান্ত কৃষকরা উচ্চমূল্যের কৃষি উপকরণ (বীজ,সার,সেচ) ব্যবহারের পর নিরাপত্তা ইস্যুতে ব্যয় বহন করতে একদম অপারগ। কেননা হাতি প্রতিরোধে সরকারি যৎসামান্য উদ্যোগের সুফল ও ক্ষতিপূরণ কৃষকের জীবনে কোন স্বস্তি এনে দিতে পারছে না। ব্যক্তিগত ও ফসলের সুরক্ষায় প্রতিরোধ সরঞ্জাম (মশাল, কেরোসিন, এলইডি টর্চ) নিজের গাঁটের পয়সাই কিনতে হচ্ছে। সুতরাং এই প্রান্তিক চাষিরা সীমান্তের উপস্থিত বাস্তবতায় ক্রমাগত নিঃস্ব হচ্ছে কেউবা জান মাল স্বর্বস্ব খোয়াচ্ছে। সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মানুষ পাহাড় থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে এবং পাহাড়ের পাদদেশে চাষবাস করে কোনরকম ডাল ভাতের সংস্থান করেন। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য ও নানা ব্যাধি তাদের নিত্যসঙ্গী। এর ওপর প্রায় বন্যহাতির আক্রমনে দিশেহারা করে দিয়েছে তাঁদের। সীমান্তবর্তী জমি চাষ করা বেশ ঝুঁকি ও প্রচুর শ্রমসাধ্য সমতলের থেকে। পতিত ও অনাবাদি জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা থেকে যায় অনেক। হাতির আতঙ্কে পতিত জায়গার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। ঝুঁকি নিয়ে চাষাবাদ করলেও সে ফসল তাঁরা ঘরে তুলতে পারছেন না। ফলে পাহাড়ি জনপদের মানুষগুলো হাতির সাথে যুদ্ধ করে মানবেতর এবং একটি আদিম সংগ্রামী জীবন কাটাচ্ছেন। বন্যহাতি ঢাকঢোল পটকা ও আগুনকে ভয় পায়। তাই এলাকাবাসী মশাল ও বন থেকে কুড়িয়ে আনা আবর্জনা জ্বালিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে বাঁশ দিয়ে পটকা বানিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে ও মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করে থাকে। অনেক সময় বাঁধা না পেলে হাতির দল গ্রামে প্রবেশ করে জানমালের ক্ষতিসাধন করে থাকে। হাতি ঠিক কখন কোনপথে সীমান্ত পারি দিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করবে তা একেবারেই অনির্দিষ্ট। তবে হাতির আক্রমণ যেহেতু বহুদশক ধরে চলে আসা প্রক্রিয়া তাই কিছু আনুমানিক ধারণা একদম অমূলক নয়। সীমান্তভেদী ভারত-বাংলা অভিন্ন পাহাড়ী নদীপথধরে বাংলাদেশের জনপদে সহজেই হাতির পাল প্রবেশ করে। এছাড়াও কিছু জঙ্গলাকীর্ণ পয়েন্ট যেখানে নিয়মিত সীমান্তরক্ষীদের টহল দেয়া সম্ভবপর নয় সেরকম কিছু জায়গা দিয়েও হাতি প্রবেশ করে থাকে। খলচান্দা গ্রামের শূন্যরেখায় বসবাস পরিমল কোচ ও রমেশ চন্দ্র কোচ নামের প্রান্তিক কৃষকের। পরিমল ও রমেশ চন্দ্র কোচ সংগ্রামী কৃষক। তাঁরা বলেছেন বড়ির আশেপাশেই অনেক জংলী জানোয়ার, ভাল্লুক, বাঘের অত্যাচার ছিলো শুনেছি গবাদি পশু ধরে নিয়ে যেতো। সন্ধ্যার পর এবারই ওবাড়ি যাতায়াত ছিলোনা। কেরাসিন এর কুপি বাতি ছিলো রাতের আলো আর চাদের আলোয় দেখা যেত কিছু। পূর্বপুরুষরা বাঘ ভাল্লুকের সাথে লড়াই করে বেঁচেছে আর এখন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা যে হাতির মত একটা বড় প্রাণী আসবে। হাতির সাথে সরাসরি লড়াই চলে তাঁদের প্রতিনিয়ত। এক সপ্তাহ আগেই আসছিলো হাতির পাল এখন শ্রীবর্দীতে অবস্থান করছে। ফসলের ক্ষতি করে অনেক আর সংঘর্ষ বেঁধে গেলে মানুষকে পিষ্ট করে মেরে ফেলে অথবা যেকোন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি হতে পারে। হাতি এলে সীমান্তরেখা লাগোয়া ক্ষেতের পাশেই মাচা/টং ঘরে সারা রাত পাহাড়া দে তারা। সাথে কেরাসিন এর মশাল থাকে, ভেপু আছে, পটকা ইত্যাদি হাতিকে ভয় দেখিয়ে ধাওয়া দেবার জন্য। যাদের যাদের ক্ষেত আছে তারাই পর্যায়ক্রমে পাহাড়ায় থাকতে হয়। বনবিভাগের প্রশাসনিক চাপের জন্য গবাদি পশু (গরু/মহিষ) পাহাড়ের টিলায় মুক্ত অবস্থায় পালন করা যায়না। সুফল মিশ্র ফল বাগান করেছে সব টিলায় তাই এখন সংসার চালানো তাদের খুবই কঠিন।
রমেশ চন্দ্র কোচ বলেন হাতি এবারও আমার ক্ষেতে ধান খেয়েছে হাতি এই গ্যালো সপ্তাহে আমরা সারা রাত পাহাড়ায় ছিলাম । ভোরবেলা তে একটু তন্দ্রা আসলাম তখন হাতি এসে ধান খাইলো অনেক বেলা পর্যন্ত। অন্য লোকজন দেখে আমাদের জাগাইলো। হাতি দশ , বিশ কিংবা পঞ্চাশ ষাট বা একটাও আসে কখনও। ২০০১ সাল থেকে এই হাতির আনাগোনাটা বেশি পাচ্ছি এই গ্রামে। সরকারিভাবে একটা কথা আছে হাতি যতটুকু ফসল ক্ষতি করেছে তার মূল্য দিয়ে দেয় এটা শুনা কথা কিন্তু এখনো আমাদের মাঝে কোন ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ টাকা পেয়েছে দেখি নাই। ধানখেতের পাশে মাচা ঘর নিজেরা বানাইছি, মশাল জ্বালানোর কেরোসিন চাষিরা মিলে কিনি আর পটকা বা ভেপু আছে। ওয়ার্ল্ড ভীষণ নামক বেসরকারি সংস্থা একটা মাচা ঘর করে দিয়েছিলো এখন সেটা পরিত্যক্ত অবস্থা। ERT বা Elephant Response Team নিয়ে তাঁরা বেশ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হাতি নামে কাঁটাতারের পাশ দিয়ে ধানখেতের মাঝে। এই ইয়ারটি এর সদস্যরা সীমান্তের প্রকৃত বাস্তবতা অনুভব করেনা বলে সীমান্তবাসী কৃষকরা জানান। এখানে ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ আছে। প্রশাসন শক্তিশালী এলিডি লাইট , ভালো উজ্জ্বল পোশাক অনেক কিছু সরবরাহ করে থাকে হাতিকে ধাওয়া দেয়ার জন্য। তাঁরা জানায় ‘হাতি প্রতিদিন আমাদের অত্যাচার করে কয়দিন তারা আসে’? হাতির আক্রমণে কাঁঠাল গাছ সীমান্তবাসী কেটে ফেলেছে। হাতি বর্ষায় কাঠাল খুব খায়। ফসলি জমিহারা হয়ে এই ভাসমান মানুষরা শহরে দিনমজুরি করে জীবিকা চালাচ্ছে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল ভিন্নমাত্রার দুর্যোগে পর্যবসিত করে সীমান্তের মানুষদের। নদীভাঙনের ফলে বন্যা দেখা দেয় হরহামেশাই। উজানের পাহাড়ধসের ফলে বড় গাছ ও অন্যান্য বনজ উপাদান ও বিপুল পলি বয়ে আনে পাহাড়ি ঢল যার প্রভাব যথেষ্ট সুদূরপ্রসারী।