দেশজুড়ে

বিলুপ্তি পথে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা

  স্বাধীন বাংলা নিউজ ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ , ৩:০৮ পিএম অনলাইন সংস্করণ

বিলুপ্তি পথে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা

মেহেদী হাসান শামীম,
শেরপুর প্রতিনিধি: বিলুপ্তি হতে চলেছে শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ লাঠি খেলা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা শেরপুরের লাঠি খেলাটি বংশ পরম্পরায় খেলে আসলেও পরবর্তী প্রজন্ম এ খেলার প্রতি আর কোন আগ্রহ নেই বলে জানা গেছে। ফলে বর্তমানে যারা এ খেলার সাথে এখনো নিয়োজিত রয়েছে তারা আর নতুন কোন খেলোয়ার তৈরি করতে পারবে না। জীবিত গুটিকয়েক যে কয়জন খেলোয়াড় রয়েছে তাদের বয়স ৬০ থেকে ৭০ এর মধ্যে। তাদের সবাই দিনমজুরের কাজ করার কারণে এ খেলার দিকে মনোনিবেশ নেই। তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে সরকারি ও সামাজিক সংগঠন থেকে কালে ভদ্রের ডাকেন খেলা প্রদর্শনের জন্য। বয়সের ভারে নুব্জ এসব খেলোয়াড় সেই আগের যৌলুস নিয়ে না খেলতে পারলেও লাঠি খেলাটা এ অঞ্চলে এখনো টিকিয়ে রেখেছে নিভু নিভু আলোর মতো।

গত ২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকেলে সদর উপজেলার ভাতশালা ইউনিয়নের মধ্য বয়রা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এ লাঠিখেলার আয়োজন করে স্থানীয় যুবসমাজ। মাদক, জঙ্গিবাদ, অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বৃদ্ধি ও দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরতে এ আয়োজন বলে জানান আয়োজকরা। খেলা দেখতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু ভিড় জমান। খেলার মাঠ পরিণত হয় মানুষের মিলন মেলায়।

শেরপুরে একসময় বিশেষ করে চলাঞ্চলে লাঠি খেলার ব্যাপক প্রচলন ছিল। সে সময় চলাঞ্চলের মানুষের বিনোদন বলতে ছিল কাবাডি ও লাঠি খেলা। কাবাডি খেলার নতুন নতুন খেলোয়ার তৈরি হলেও লাঠি খেলায় বংশ পরম্পরা ছাড়া খেলোয়ার তৈরি হয় না। আধুনিক সভ্যতার নানান খেলাধুলা ও মোবাইল ডিভাইসের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে লাঠি খেলাটি বিলুপ্তপ্রায়। একসময় জেলায় পহেলা বৈশাখ, চৈত্র মেলা ও মহরম উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে এ লাঠি খেলা প্রদর্শন হতো। কিন্তু দিন দিন খেলোয়ার কমে যাওয়ায় এ খেলায় আগের মত আর প্রদর্শন হয় না। তাছাড়া এ খেলার সাথে জড়িতরা তারা সবাই দিনমজুরের কাজ করে বলে এই খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারপরেও বংশ পরম্পরায় তৈরি হওয়া খেলোয়ারদের মধ্যে সর্বশেষ প্রজন্ম এখনো এ খেলাটিকে টিকিয়ে রেখেছে। বিলুপ্তপ্রায় গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম বেশি বেশি এ খেলার আয়োজনের কথা জানান।

লাঠি খেলার মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি নাম। এসবের মধ্যে হল লাঠি খেলা, স্থানীয় ভাষায় পাজুন খেলা, দা খেলা এবং থালা খেলা। তবে এই খেলার মূল কারিগর হচ্ছে ‘বায়ানকারি’। অর্থাৎ বাজনা বাদক দল বা ঢুলি। বায়ানের কালের ওপর খেলোয়ার খেলে যান। বায়ান এর তাল ঠিকমতো না হলে খেলোয়াড়দের খেলাও ভুল হয়। অর্থাৎ শরীরে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

প্রবীণ লাঠিয়ালরা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, এ খেলা তারা বংশ-পরম্পরায় খেলে আসছে। বর্তমানে যারা এই খেলাটি কিছুটা হলেও রপ্ত করে রেখেছে তাদের আগামী প্রজন্মের কাছে খেলাটি তুলে দিতে না পারার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ সর্বশেষ প্রজন্মের যে খেলোয়াড় রয়েছে তাদের ছেলেরা এ খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন।

লাঠি খেলায় অংশ নেওয়া প্রবীণ লাঠিয়াল সদর উপজেলার ভাতশালা ইউনিয়নের সাপমারি গ্রামের আব্দুর রাজ্জক জানান, আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে বিভিন্ন এলাকায় লাঠি খেলে খেলে আসছি । আমি আমার বাবার কাছ থেকে এখানে শিখেছিলাম। কিন্তু এ খেলায় তেমন কোন আয়-রোজগার নেই। একসময় শখের বসে এবং মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য এ খেলা খেলতাম। এখন খেলাটি বিশেষ দিনে খেলা হয়ে থাকে। বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ, মহরম, ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চে প্রশাসনের লোকজন ডেকে নিয়ে খেলা প্রদর্শন করে থাকেন। বছর জুড়ে বসে থাকতে হয়। তাই এ খেলার উপর নির্ভর না করে আমাদেরকে দিন মজুরের কাজ করতে হয়। আমাদের ছেলেরাও এ খেলার প্রতি কোন আগ্রহ নেই। তাই তারা এ খেলা আমাদেরও বাদ দিতে বলেন। ফলে আমারা মারা গেলে আর কোন খেলোয়াড় থাকবে না তখন হয়তো শেরপুরে এ খেলা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

একই গ্রামের লাঠিয়াল ইউসুফ মিয়া (৬৫), মোহাম্মদ নাছিমুদ্দিন (৭০), আব্দুস সালাম (৫৫), সেকান্দর আলী (৭০), আব্দুর রহমান (৬৫) জানায়,‌ একসময় সদর উপজেলার আমাদের চর পাকুরিয়া গাছের খামার ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে অনেক লাঠিয়াল দল ছিলেন। এখন হাতেগোনা তিন-চারটি গ্রামে দু’চারজন করে লাঠিয়াল রয়েছে। অনেকে আবার বয়সের কারণে আগের মত খেলার দমও নেই।

তবে এই খেলার সঙ্গে জড়িতরা প্রায় সবাই গরিব‌ দিনমজুরের কাজ করে থাকেন। তারা দুঃখ-দৈন্যে জীবনযাপন করেন। তাদের জন্য সরকারিভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নেই। তেমন কোনো ব্যবস্থা হলে নিয়মিত চর্চা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা এই খেলাকে আরও বড় পরিসরে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারতেন।

প্রবীণ লাঠিয়ালরা বলেন, ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া সব খেলা রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

বিশ্বায়নের কারণে হারিয়ে যাওয়া এ খেলাটি ধরে রাখতে বেশি বেশি এ খেলা আয়োজন করা উচিত বলে মনে করেন জেলার সচেতন নাগরিকরা। এতে করে পজিটিভ বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে বলে মনে করেন তারা।

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় যুবক ও সচেতন মহলের পাশাপাশি সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন জেলার সচেতন নাগরিক।