দেশজুড়ে

জেল থেকে মা এর কাছে চিঠি:বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম জিন্নাহ

  স্বাধীন বাংলা নিউজ ২৩ জানুয়ারী ২০২৪ , ১০:৩৪ এএম অনলাইন সংস্করণ

১৯৮৩ সালের ১৭ জানুয়ারী সিলেট জেল থেকে আমার মা- এর কাছে লেখা এ চিঠিটিএখন আমার কাছে স্মৃতি।

মা।

কিছুক্ষণ আগে ঘন্টা ধ্বনির শব্দটা কারাগারের আঠার ফুট উচু পাষাণ প্রাচীর ভেদ করে আমার কানে বেজে উঠলো।এখন রাত দুটো। কী ভীষণ শীত এখানে। হাড় কাঁপানো শীতের রাতে চারিদিকে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। সুরমা নদীর পাড়ে ব্রিটিশের তৈরি কারাগারের সমস্ত বন্দিরা ঘুমের ঘোরে বিভোর। কেউ কেউ হয়তো জেগে আছে আমার মতো। কিন্তু কোন শব্দ নেই। আমার রুমের অন্য দু’জন সহবন্ধীও নিদ্রা দেবীর কোলে মাথা রেখে এতোক্ষণে অচেতন। এই নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে আমার কানে ভেসে আসছে রুমের সম্মুখে পায়চারি রত প্রহরীর বুটের শব্দ।সে হয়তো মনের মাধুরি মিশিয়ে আপন ভূবণ রচনা করে চলছে।এখানে জেগে শুধু আমি আর প্রহরী।আমার মনের পর্দায় এখন ভেসে উঠেছে সে তো তোমারই ছবি মা। কতদিন, কত বছর আমি তোমাকে দেখিনা। তোমার স্মৃতি গুলো এই বিনীদ্র রজনীতে ভীষণ যন্ত্রণা দেয় মা। আমার কি মনে হয় জানো মা —– মনে হয় কত যুগ, কত শতাব্দী পেরিয়ে গেল তোমাকে দেখিনা। তোমার বুকের ধন আচঁলের নিধি তোমার কাছ থেকে আজ অনেক অনেক দূরে। বঙ্গোপসাগরের এই উপকূলীয় ভূখণ্ডে জন্মেছি মা তোমারই পেটে।সারা দুনিয়ার সকল মায়েরা সকল সন্তানের কাছে এক অভিন্ন সত্তা। আমি আজ দূরে বহু দূরে সুরমা নদীর পাড়ে থাকলেও আমার বিবেকের বোতাম গুলো খুলে দেখলাম তুমি আমার হৃদয়ে।তোমার বুক ভাঙ্গা ক্রন্দন আর মর্মভেদী হাহাকার যে আমার বুকে ভীষণ বাজছে।মা,তুমি কি কখনো বরফ দেখেছো? কিম্বা বরফ গলা নদী? আমি কিন্তু দেখেছি। বরফ কী ভীষণ শক্ত। শাবল দিয়ে পিটিয়ে ভাঙতে হয়। কিন্তু বরফ যখন গলতে শুরু করে তখন একটা নদীর সৃষ্টি করে ;শাবলের দরকার তখন ফুরিয়ে যায়। গত কিছুদিনের পথ চলায় আমার মনটা যেন বরফ গলা নদী হয়ে গেছে।

মা,তুমি কি কখনো সিনেমা দেখেছো কিংবা বাইস্কোপ? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো ছবির দৃশ্যগুলো এক এক করে ভেসে ওঠে একটা সাদা অথবা রঙিন পর্দায়। আজ যতদূর মনে পড়ছে আমার শৈশব, আমার কৈশোর, যৌবনের একটা সময় পর্যন্ত তোমার সকল স্মৃতি ছবি হয়ে আমার মনের পর্দায় এক এক করে ভেসে উঠছে। তোমার আমার অবস্থানগত দূরত্ব অথবা কারাগারের ১৮ ফুটের চার দেয়াল এসব কোন কিছুই স্মৃতিগুলোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না।এবং তা পারা কারো পক্ষে কখনো সম্ভব নয়।
মা,তোমার ছয়টি সন্তানের মধ্যে আমি সবার ছোট। রসিকতা করে গ্রামের চাচা জেঠারা আমাকে থলি ঝাড়া ছেলে বলতো। আমাকে কেন যে এত বেশি আদর, স্নেহ করতে তা শুধু তুমিই বলতে পারো।অথচ আমিই তোমাকে বেশি জ্বালিয়েছি কাঁদিয়েছি। সব সময় বাবার অনুশাসন থেকে তোমার শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে ঢেকে রেখেছো। এ জন্য রাস ভারি শিক্ষক বাবার বকুনি তোমাকে কম সহ্য করতে হয়নি। তবুও আমার প্রতি তোমার আদরের ঘাটতি তো দেখিনি কখনো। আমার জীবনে দুটো ঘটনার সময় সবচেয়ে বেশি বিচলিত ও উদ্বিগ্ন দেখেছি তোমাকে। তাও আবার আমারই জন্য। ১৯৭১ সাল।চারিদিকে যুদ্ধের আওয়াজ, বাতাসে বারুদের গন্ধ। গোলার ধোঁয়ায় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ঐ সময় তুমি আমাকে তোমার চোখে চোখে রাখতে চেয়েছো।পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী যেদিন আমাদের গোটা বাড়িটা পুড়ে ছাই করে দিল সেদিনও তোমাকে এতটুকু চিন্তিত দেখিনি যতটুকু চিন্তা ছিল আমার জন্য। কৈশোরের সীমানা ছাড়িয়ে যৌবনের প্রথম সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে যে যুবক তার মাকে ভালবাসতে শিখে জন্মভূমিকে ভালবাসতে শিখেছে তাকে যে শিকল পড়িয়ে আটকে রাখা যায় না। তাইতো একদিন তোমার চোখে অশ্রু ঝরিয়ে তোমাকে চিন্তার চিতায় জ্বালিয়ে পালিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। আমার যে ডাক এসেছে মা, আমাকে তো যেতেই হবে। অবশেষে বিজয়ের মালা গলায় পড়ে যেদিন বাড়ি এলাম সেদিন তুমি আমার মাথা তোমার বুকে রেখে কেঁদে ছিলে। আমিও অনেকদিন পর তোমার বুকে মাথা রেখে কেঁদেছিলাম। তবে আমাদের উভয়ের অশ্রু ছিল আনন্দ অশ্রু।
আর একদিনের কথা। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট, বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে একদল বিশ্বাস ঘাতক সপরিবারে হত্যা করলো।বঙ্গবন্ধুকে বাঙালিরা রক্ষা করতে পারেনি।প্রতিক্রিয়াশীল খুনিদের হিংস্র থাবার কাছে আমরা পরাজিত হলাম।বিশ্ববাসীর কাছে আমরা নিন্দিত হলাম। কিন্তু আত্মসমর্পণ করিনি। আমার মাথার উপর তখন হুলিয়া। পুলিশ মাঝে মাঝেই হামলা করে বাড়িতে। আমি লুকিয়ে থাকি এ বাড়ি ও বাড়ি, এ গ্রাম ও গ্রাম। তুমি আমার বিপদের আশঙ্কায় আশঙ্কিত। অথচ আমি একদিন সেই কাঁটা বিছানো পথেই পা বাড়িয়ে দিলাম। আমি তো জানি কাঁটা আমার পায়ে বিঁধবে।তবুও বিবেক আমায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যে নেতার ডাকে আমি আমার স্বদেশ ভূমির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি সেই নেতার মৃত্যুকে আমি যে মেনে নিতে পারি নাই। তাইতো বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে আমাদের উত্তর সীমান্তে গারো পাহাড়ের পাদদেশে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় মুক্তিবাহিনীতে(কাদেরিয়া বাহিনী) যোগদান করি।আমার জঙ্গলে চলে যাওয়ার খবরটা তোমাদের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দেখা না করেই চলে গেলাম। আমিতো জানি চোখের জলে তুমি বুক ভাসাবে। তবু সে পথটাই আমাকে বেছে নিতে হলো। বন- জঙ্গলটা যেন আমার কাছে একটু বেশী ভালো লাগে। ১৯৭১ সালের মতো এবার আর তোমার কোলে ফিরে গেলাম না— ফিরে এলাম সামরিক স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের কারাগারে। এ বারের যুদ্ধটা ‘৭১ এর মতো পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছিল না —- ছিলো বিদেশী বিশেষ করে আমেরিকা আর পাকিস্তানি মদদ পুষ্ট দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী আর সামরিক স্বৈরাচার জিয়ার বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ বা বিচার না হওয়া পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবেই।
১৯৭৬সালের ৯ জুলাই। রাত তখন একটা বাজে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সারাটা আকাশ মেঘে ঢাকা পড়ে আছে। যে কোনো সময় বৃষ্টি শুরু হতে পারে। সমস্ত বাড়িটায় যেন কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। ঘরের কপাটে ধাক্কা দিয়ে “মা” বলে ডাক দিতেই তুমি বিছানা ছেড়ে কপাটের খিল খুলে দিয়ে “বাবা তুই এসেছিস” বলেই তোমার বুকে টেনে নিলে। ততক্ষণে বাবাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মা, তুমি যে রাত একটার সময়ও ঘুমাওনি এবং বিছানায় শুয়ে আমার কথাই যে ভাবছিলে তা বুঝতে আমার একটুকু অসুবিধা হয়নি।আমার আজও মনে পড়ছে, নিঃসন্দেহে মনে পড়ছে মা, আমাদের রান্না ঘরের পিছনে সাগর কলা গাছের সদ্য নামানো বড় বড় দেখে বেশ ক’টা পাকা কলা ধানের গোলা থেকে নামিয়ে আমাকে এবং আমার সাথের এক সহযোদ্ধাকে খেতে দিয়েছিলে ;ইতিমধ্যে বড় ভাইদের সবাই, বড় ভাবী,মেঝো ভাবী এসে হাজির। বড় ভাইদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের (লিপা,শিখা, বুলবুল, সোহেল, উজ্জ্বল, মেরীন) ঘুম থেকে ওঠানো হয়নি। পরের দিন যদি ওরা কারো সাথে গল্প করে যে ‘আমার ছোট কাক্কু এসেছিলো’– এই ভয়ে। আমি তো তখন অন্য গ্রহের মানুষ। মাছ আর খাসির মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম।তুমি নিজ হাতে আমাকে খাওয়ায়ে দিয়েছিলে।আজ অব্দি সেই ছিল বাড়িতে আমার শেষ খাওয়া। খাওয়ার শেষে প্রায় আড়াইটার দিকে বিদায়ের পালা। এর মধ্যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাহিরে তখন বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। তোমার চোখ দু’টি তখন জলে পূর্ণ। সবার সাথে তুমিও পুকুর পাড় পর্যন্ত চলে এসেছিলে। শেষবারের মতো আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলে। আমি বুঝতে পারলাম তোমার কন্ঠ কান্নায় ভেঙ্গে আসছে। আমিও একটু আবেগ প্রবণ হয়ে উঠেছিলাম।ডান হাত থেকে স্টেন গানটা বাম হাতে ধরে বাবাকে এবং পরে তোমাকে সালাম করে দেরি করলাম না —- চলে এলাম গোপন আস্তানায়। সেই ছিলো তোমাদের সাথে আমার শেষ দেখা। সেই যে এলাম আর দেখা নেই। ১৯৭৮ সালে আমি তখন বরিশাল জেলে। আমার রাশ ভারী বাবা দেখা করতে গিয়েছিলেন।কিন্তু দেখা হয় নাই। তখন আমার সাথে দেখা করতে উচ্চ মহলের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। এসব স্মৃতি যে আমাকে কি যন্ত্রনা দেয় দুনিয়ার অন্য কেউ না বুঝলেও তুমি বুঝবে– এ বিশ্বাস আমার আছে মা।

আজ দূরে বহু দূরে পাষাণ পুরীতে বসে যখন এসব কথা ভাবছি তখন আমার চোখ অস্ত্রসিক্ত। আমার মা, তোমার কথা যতই ভাবি তোতুই আমি তন্ময় হয়ে যাই। তুমি আশীর্বাদ করো মা — আমি যেন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রশ্নে আপোস না করি। স্বৈরাচারী সরকারের বিকট হিংস্র দানব আর পাশবিকতা দেখে আমি যেন ভয় না পাই। ভীরুতা, কাপুরুষতা আমাকে যেন স্পর্শ করতে না পারে। আমার চেতনার সৈকতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী হিসাবে কাজ করে যেতে চাই আমৃত্যু।

আমার মাকে বলছি, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে ডাকাতিয়া কান্দা গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ ভাইয়ের মায়ের কথা। বেচারি কত কষ্ট করে একমাত্র পুত্রকে লেখাপড়া শিখাচ্ছিলো। তার দুঃখ ভরা জীবনের কথা আমার চেয়ে তুমিই বেশি জানো মা। বেচারী তোমার সাথেই তার দুঃখের কথা আলাপ করতো। ‘৭১ সালে যুদ্ধ শেষে আমরা সবাই ফিরে এলেও আরো অনেকের মতই সুরুজ ভাই ফিরে এল না। সুরুজ ভাইয়ের মা একমাত্র পুত্রের জন্য কি কান্নাই না কেঁদেছিল তোমার কাছে। দরিদ্র সুরুজ ভাইয়েরা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিল। অথচ কিছু লোক আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হল কলাগাছ ফুলে বটগাছ হল বটগাছ ফুলে জোড়া বটগাছ হল। বাজ পাখি শকুনেরা খাবলে খাচ্ছে এ দেশটাকে। স্বাধীনতার বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সুরুজ ভাইয়েরা কি হারিয়ে যাবে?

মাগো,মা—- পুরানো স্মৃতি নতুন করে জাগিয়ে শুধু তোমাকেই ব্যথা দিচ্ছি না আমার অন্তরের অন্তরতম প্রদেশেও কান্নার সুর বেজে উঠছে। এ দিকে আর অগ্রসর না হওয়াই ভালো। আজকের মত এখানেই বিদায় নিতে চাই মা। তার আগে ছোটবেলার মতো আমার কপালে একটা আশীর্বাদের চুম্বন এঁকে দাও মা।আবার দেখা কবে হবে জানি না। তোমার দোয়াই আমার চলার পথের পাথেয়।অবশেষে আমার মাকে ভক্তি, শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

ইতি–
তোমার আদরের ছেলে।।
সাজা প্রাপ্ত রাজবন্দী
কয়েদি নম্বর — ১৭০০/ এ
সিলেট জেলা কারাগার
১০ নং সেল,কক্ষ নং ০৪।
১৭ জানুয়ারী ‘১৯৮৩ সাল।